কাঁটা ও ফুল
একদিন ডাক্তার আমাদের স্কুলে আসেন এবং আমাদের ক্লাসে প্রবেশ করেন। তিনি আমার নাম জিজ্ঞাসা করে নোট করে নেন। বুঝতে পারি, আমাকে একটি খাবারের কুপন দেওয়া হবে। কয়েকদিন পর সেই কুপনটি পাই, আর সেই মুহূর্তে আমার আনন্দের সীমা থাকে না। আমি খুবই উত্তেজিত হয়ে বাড়ি ফিরে যাই এবং আমার ভাইবোনদের এ খবর জানাই। আমার বোন ফাতিমা খুব রেগে যায় এবং কুপনটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। সে চিৎকার করে বলে, আমরা গরিব নই! আমি তখন মাকে ডাকি। মা এসে ফাতিমাকে বোঝান যে খাবারের কুপন নেওয়াতে কোনো লজ্জা নেই, কারণ আমরা শরণার্থী, এবং UNRWA-এর সহযোগিতায় আমরা বেঁচে আছি। আমাদের ঘরবাড়ি, স্কুল, স্বাস্থ্যসেবা সবই UNRWA দ্বারা পরিচালিত। মা বোঝান যে, কুপন পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, বরং এটা আমাদের পরিস্থিতির স্বাভাবিক ফল। যখন মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তখন UNRWA-ই তাদের জন্য নতুন বাসস্থান তৈরি করে দিয়েছিল। ফলে ফাতিমা বাধ্য হয়ে আমাকে কুপনটি ফেরত দেয়, যদিও সে এতে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিল না। প্রতিদিন ক্লাসের বিরতিতে বা ক্লাস শেষে শত শত ছেলে-মেয়ে UNRWA স্বাস্থ্য কেন্দ্রের খাবারের জন্য যেত। আমরা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে কুপন দেখানোর জন্য অপেক্ষা করতাম, আর লাইনে দাঁড়িয়ে ঠেলাঠেলি করতাম যেন আগে ভিতরে ঢুকতে পারি। ভিতরে ঢোকার পর সবাইকে চুপচাপ থাকতে হতো, কারণ খাবার পরিবেশনের দায়িত্বে থাকা পরিচালক টেবিলের পিছনে বসে আমাদের কুপন গ্রহণ করতেন, কুপনে তারিখ ও সময়ের পাশে টিক চিহ্ন দিয়ে কুপন ফেরত দিতেন। এরপর আমাদেরকে ছোট একটা রুটি দিতেন, আর অন্য একজন কর্মী আমাদের প্লেটে তিন থেকে চার ধরনের খাবার পরিবেশন করতেন—যার মধ্যে ফলমূল বা মিষ্টান্নও থাকত। আমরা সেই প্লেটটি নিয়ে খাবার ঘরে যেতাম, টেবিলে বসে সুস্বাদু খাবার খেতাম। খাবার শেষে প্লেটটি রান্নাঘরের জানালায় রেখে আসতাম, যেন তা ধুয়ে পরিষ্কার করা যায়। বের হওয়ার সময় দরজার কাছে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের একজন কর্মী দাঁড়িয়ে থাকত, যাতে কেউ খাবার বাইরে নিয়ে যেতে না পারে। কেউ যদি খাবার চুরি করতে ধরা পড়ত, তাকে সেই খাবার সেখানেই খাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হতো। আমার চাচাতো ভাই ইবরাহিম ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, আর আমরা সবসময় একসঙ্গে থাকতাম। একদিন, মঙ্গলবার, আমরা পরিকল্পনা করি যে, তার জন্য কিছু কাবাব রুটির মধ্যে ভরে দেব। কারণ মঙ্গলবারের খাবার ছিল কাবাব, তাই ছোট একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি টেবিলে বসে আছি, ইবরাহিম দরজার পাশে অপেক্ষা করছে। সতর্ক ও দ্রুততার সাথে আমি আমার রুটির অর্ধেক কাবাব প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে প্যান্টের ভেতরে লুকিয়ে রাখি। বাকি খাবার খেয়ে নিই, আর আশপাশে নজর রেখে নিশ্চিত করি যে, কেউ আমাকে দেখে ফেলেনি। রান্নাঘরের জানালায় প্লেট রেখে আমি বাইরে বেরিয়ে আসি, একদম শৃঙ্খলাবদ্ধ ছেলের মতো আচরণ করি। বাইরে এসে হাত তুলে দাঁড়াই যেন তল্লাশির সময় কেউ সন্দেহ না করে। এরপর দ্রুত বেরিয়ে এসে চারদিকে তাকিয়ে ইবরাহিমকে খুঁজতে থাকি, আর প্যান্টের ভেতর থেকে রুটি বের করার জন্য হাত ঢোকাই। ঠিক তখনই দেখি প্রায় ত্রিশজন ছেলে, যাদের আমরা হিক্সোস বলে ডাকি, আমার দিকে ছুটে আসছে রুটির স্যান্ডউইচ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। আমি দৌড়াতে শুরু করি, আর তারা পিছন পিছন ছুটতে থাকে। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে দৌড়াই, একটা দীর্ঘ পথ পেরিয়ে যাই। মনে হচ্ছিল, তাদের থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছি। পিছনে তাকিয়ে দেখতে যাই, যদি তারা থেমে থাকে বা ফিরে গেছে কিনা। তখনই একজন ছেলের ছোড়া একটি বড় পাথর সরাসরি আমার চোখে এসে লাগে। আমার সামনে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়, আর রুটির অর্ধেক মাটিতে পড়ে ধুলোয় ঢেকে যায়। আমি সেটি আর তুলতে পারি না বা তোলার ইচ্ছাও হয় না। আমি কুপনটা হাতে ধরে বাড়ির দিকে দৌড়াতে থাকি, আর চিৎকার করতে করতে মাকে ডাকি, ‘মা!’ হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে দীর্ঘ পথ দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়িতে পৌঁছাই। মা আমাকে দেখে আতঙ্কে লাফিয়ে ওঠেন এবং আমার চোখ দেখে চিৎকার করে বলেন, হায় রে, ছেলের চোখ তো গেল! তিনি তাড়াতাড়ি তার মাথার স্কার্ফ তুলে নেন এবং আমাকে নিয়ে ছুটতে থাকেন। কখনও কোলে নিয়ে, কখনও হাত ধরে টেনে নিয়ে যান UNRWA ক্লিনিকে। অনেক কষ্টের পর আমরা ক্লিনিকে পৌঁছাই এবং চোখের চিকিৎসা কক্ষে যাই, যেখানে একজন বিশেষজ্ঞ নার্স ছিলেন। সেখানে পৌঁছে মায়ের কাছে কুপন চাওয়া হয়, যা ছাড়া চিকিৎসা সম্ভব ছিল না। মা কুপন আনতে ভুলে গিয়েছিলেন, আর নার্স কুপন ছাড়া চিকিৎসা করতে অস্বীকৃতি জানান। মা অনেক অনুরোধ করেন, মিনতিও করেন, কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয় না। তারা জানায়, কুপন ছাড়া চিকিৎসা করা যাবে না। মা আমাকে চেয়ারে বসিয়ে রেখে কুপন আনতে ছুটে যান, ক্লিনিক বন্ধ হওয়ার আগে। নার্স নিশ্চিত হন যে, মা সত্যিই কুপন আনতে গেছেন। তিনি আমাকে ডেকে চেয়ারে বসান এবং আমার চোখ পরীক্ষা করতে শুরু করেন। তারপর চোখের ওপর মোটা কাপড়ের পট্টি রেখে সেটি বেঁধে দেন। আমি মায়ের ফেরার অপেক্ষায় থাকি। মা ফিরে আসেন হাঁপাতে হাঁপাতে, দীর্ঘ পথ পেরোনোর ক্লান্তি নিয়ে। তারা রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া শেষ করে, আর নার্স নিশ্চিত করেন যে, আমার চোখে বড় কোনো সমস্যা নেই। মা তখন আমাকে স্নেহভরে হাত ধরে ধীরে ধীরে বাড়ির পথে নিয়ে যেতে থাকেন। এই সুযোগে আমার বোন ফাতিমা আমার খাবারের কুপনটি ছিঁড়ে ফেলে। তখন মনে হলো, আমার আসল সমস্যা আসলে চোখের আঘাত না বরং, কুপন আর ফিরে না পাওয়া। আমাকে খাবারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, যেন আমার আরেকটি চোখই নষ্ট হয়ে গেছে।